ড. এম জসিম আলী চৌধুরী: নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ নিয়ে একটি সাংবিধানিক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এই শপথ গ্রহণ আক্ষরিক অর্থে সাংবিধানিক হতে পারে। তবে এ নিয়ে আর কিছু সোজাসাপ্টা প্রশ্নের উত্তরও আমাদের খুঁজতে হবে।
একটি আক্ষরিক পাঠ
অনুচ্ছেদ ১২৩(৩)(ক) অনুযায়ী আগের সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। সেই তিন মাসের মধ্যেই গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অনুচ্ছেদ ১৪৮(২ক)-তে বলা হয়েছে নির্বাচনের ফলাফল গেজেট করার তিন দিনের মধ্যে শপথ গ্রহণ করতে হবে। এ বিধানটি ২০০৪ সালে চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিএনপি সরকার কর্তৃক ঢোকানো হয়। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ৩৯(৪)-তে নির্বাচন কমিশনের গেজেট প্রকাশের জন্য ন্যূনতম বা সর্বোচ্চ সময়সীমা উল্লেখ নেই। কমিশন গেজেট প্রকাশ করলে স্পিকার তিন দিনের মধ্যে শপথ পড়াতে বাধ্য।
অনুচ্ছেদ ১৪৮(৩) বলছে এমপি-রা শপথ নেওয়ার পর “অবিলম্বে” (“immediately”) কার্যভার গ্রহণ করবেন। অন্যদিকে অনুচ্ছেদ ১২৩(খ) খুব স্পষ্টভাবে বলে যে, নবনির্বাচিত এমপি-রা আগের সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে দ্বায়িত্ব নেবেন। একাদশ সংসদের মেয়াদ এ বছরের ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, অনুচ্ছেদ ১৪৮(৩)-র নিয়মটি অন্য সকল শপথ গ্রহণকারী পদাধিকারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও এমপিদের জন্য হবে না। কারণ ১২৩(খ) অনুচ্ছেদে তাঁদের জন্য আলাদা নিয়ম আছে। আইন ব্যাখ্যার নিয়ম হলো, সাধারণ নিয়মের উপর নির্দিষ্ট নিয়ম প্রাধান্য পাবে। তবে ব্যাখ্যার এ নিয়ম দিয়েও সমস্যার শেষ হচ্ছে না। সংবিধানের তৃতীয় তফসিলে এমপিদের জন্য দেয়া শপথে একটি অতিরিক্ত ঝামেলা আছে।
শপথে বলা আছে, সংসদ সদস্য তাঁর “দায়িত্ব গ্রহণ করিতে যাইতেছেন” (“about to enter”)। “করিতে যাইতেছেন” (“about to enter”) কথাটা-র দুই অর্থ হতে পারে। প্রথমত, এটি একটি তাৎক্ষণিক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিতে পারে। আমরা বলতে পারি যে, এমপি-রা তাঁদের শপথ নেওয়ার পর “অবিলম্বে” (“immediately”) অফিসে প্রবেশ করছেন। এই অর্থটি অনুচ্ছেদ ১৪৮(৩) এর সাথে যায়। দ্বিতীয়ত, সাধারণ ধারণায় “করিতে যাইতেছেন” (“about to enter”) কথাটা কাছের, কিন্তু বেশি দূরের না এমন, ভবিষ্যতেরও ইঙ্গিত দিতে পারে।
আমরা এটাও বলতে পারি যে, “করিতে যাইতেছেন” (“about to enter”) এর অর্থ অদূর ভবিষ্যতে তাঁদের দায়িত্ব নেয়া। এ অর্থটি ১২৩(খ) অনুচ্ছেদের সাথে মানান সই। ১২৩(খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তাদের ২৯ জানুয়ারী ২০২৪ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাহলে প্রশ্ন হলো, “about to enter” এর দুই অর্থের মধ্যে কোনটি আমরা নেবো? সঙ্গত কারণেই আমাদের ওই অর্থটি নিতে হবে যেটি নির্দিষ্ট বিধানটির সাথে মিলে। এটি সাধারণ বিধানের সাথে মিলে যাওয়া অর্থটির উপর প্রাধান্য পাবে।
দেখা যাচ্ছে, সংবিধানের আক্ষরিক পাঠে হয়তো ১১ জানুয়ারির শপথটি টিকে যাবে। তারপরও আরেকটি প্রশ্ন থেকে যায়।
একটি বিবেক তাড়িত প্রশ্ন
১১ জানুয়ারী ২০২৪ থেকেই কি নবনির্বাচিত এমপিদের বেতন-ভাতা শুরু হয়েছে? আমি সংসদ সদস্য (বেতন ও ভাতা) আদেশ ১৯৭৩ দেখার চেষ্টা করেছি। ধারা ২(ঘ) বলছে এমপিদের অফিসের মেয়াদ তারা যেদিন তাঁদের চাকরিতে প্রবেশ করে সেদিন থেকে শুরু হয় এবং তাঁদের মেয়াদ শেষ হওয়ার দিনে শেষ হয়। যদি উপরে উল্লিখিত আক্ষরিক ব্যাখ্যা ধরে আমরা বলি যে নতুন শপথ নেয়া সংসদ সদস্যরা একাদশ সংসদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দ্বায়িত্বে প্রবেশ করবেন না, সেক্ষেত্রে ২৯ জানুয়ারির আগে তাঁদের বেতন ভাতা শুরু হওয়া উচিত নয়। প্রশ্ন হলো, দশম ও একাদশ সংসদের শুরুতে কি এটি মানা হয়েছিল? আমি মনে করি বাংলাদেশের জনগণ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার হকদার ।
একটি সাংবিধানিক অস্বাভাবিকতা
শপথ নিয়ে জটিলতার এ পুরো ব্যাপারটিতে আমাদের একটি সাংবিধানিক অস্বাভাবিকতা (anomaly) আছে। প্রশ্ন করি, ১১ জানুয়ারি সংসদ সদস্যদের এত তাড়াতাড়ি করে শপথ নেওয়ার কী দরকার ছিল? এটি করতে হয়েছে দুটি কারণে। প্রথমত, একটি পদ্ধতিগত সাংবিধানিক রীতি (procedural convention) যা আমরা অতীতে তৈরি করেছি এবং দ্বিতীয়ত, ২০০৪ সালের বিতর্কিত সাংবিধানিক সংশোধনী যা আমাদের বর্তমান বাস্তবতার সাথে খাপ খায় না।
একটি পদ্ধতিগত সাংবিধানিক রীতি
আমরা দেখে আসছি আমাদের দেশে নির্বাচনের পর সাংসদরা শপথ নেন, দলগুলি তাঁদের সংসদীয় দলের সভা ডাকে, নেতা নির্বাচন করে এবং তারপর মেজিরিটি পার্টির নেতাকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ দেন। আমরা যদি এটিকে একটি পদ্ধতিগত সাংবিধানিক রীতি (procedural convention) বলতে চাই তবে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ এ প্রথাটি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাথে বেশি খাপ খায়। তখন নির্বাচনের আগে পূর্ববর্তী সংসদগুলি ভেঙে দেওয়া হতো। রাষ্ট্রপতি নতুন সংসদ সদস্যদের শপথ নেয়া এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে নেতা নির্বাচন করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে কোন সমস্যা ছিল না।
কিন্তু এখন আগের সংসদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে নির্বাচন হয়। আগের সংসদ বিলুপ্তও হয় না। এখন প্রধানমন্ত্রী কে হবেন সেটা জানার জন্য সংসদ সদস্যদের শপথ নেয়া এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নেতা নির্বাচন করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে দেখা যাচ্ছে, দেশে দুইটি সংসদ সৃষ্টি হয়ে বসে থাকছে। সুতরাং প্রশ্ন হলো, বর্তমান ব্যবস্থার সাথে পদ্ধতিগত সাংবিধানিক রীতিটি কি মানায়? সম্ভবত না। বর্তমানে এটির আসলে দরকারও নেই।
আমার বিবেচনায় অনুচ্ছেদ ৫৩(৩) এবং(৪)-তে এমন কিছু নেই যেটি নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের আগে রাষ্ট্রপতিকে সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ এবং নতুন সংসদ অধিবেশনে বসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলছে। শুনতে কিছুটা অস্বাভাবিক লাগলেও এটা সত্য। ৫৬(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি এমন একজনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন যিনি তাঁর বিবেচনায় (who “appears to him”) সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপিদের সমর্থনপুষ্ট। ঐতিহাসিকভাবে, ভারতীয় রাষ্ট্রপতিরা নির্বাচনের ফলাফল স্পষ্ট হওয়ার পরপরই, নতুন সংসদের আনুষ্ঠানিকভাবে আহবান করার এবং সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়ার আগেই, প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছেন। এটি মৌন সংসদীয় সমর্থন (negative parliamentary investiture) হিসাবে পরিচিত।
ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোটের নেতার উপর সংসদের আস্থা আছে বলে ধরে নেওয়া হয় যতক্ষণ না সংসদ অনাস্থা ভোট পাশ করে। সন্দেহ থাকলেও রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন। তারপর তাঁদেরকে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে বলেন। ভারতীয় রাষ্ট্রপতিরা তাঁদের সংবিধানে স্পষ্ট কোন বিধান না থাকা স্বত্তেও কাজটি করেন। বিবেচনা প্রসূত ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।
আমাদের রাষ্ট্রপতির কাছে বরং “appears to him”-এর মতো সাংবিধানিক ক্ষমতা আছে। দ্বিতীয়ত, অনুচ্ছেদ ৫৬(৩) এবং ৫৭(৩) একসাথে মিলিয়ে পড়লে দেখা যাবে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে প্রবেশ এবং মেয়াদ পূর্তি সংসদের শুরু বা মেয়াদের উপর নির্ভর করে না। রাষ্ট্রপতি সংসদ ডাকার আগে প্রধান মন্ত্রী নিয়োগ দিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর নতুন প্রধান মন্ত্রীর শপথ না নেয়া পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারেন।
একটি বিতর্কিত সাংবিধান সংশোধনী
২০০৪ সালের চতুর্দশ সংশোধনী গেজেটের তিন দিনের মধ্যে শপথ নেওয়া বাধ্যতামূলক করে তোলে। ঠিক কী ধরণের সাংবিধানিক জরুরত বিএনপি সরকারকে এই পরিবর্তন করতে প্ররোচিত করেছিল তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ধারণা করতে পারি, ২০০৬ এর শেষের দিকে অনুষ্টিতব্য পরবর্তী সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে তাঁদের হয়ত কিছু উদ্বেগ ছিল এবং ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তাঁদের সাজানো তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনোভাবে সে নির্বাচনটি করে ফেলতে পারলে সরকার গঠনে তারা হয়ত বেশি দেরি করতেন না। যা-ই হোক, নতুন ব্যবস্থার সাথে বেমানান হয়ে পড়লেও বিধানটি এখনো আছে।
দুটি সম্ভাব্য সমাধান
প্রথমত, ২০০৪ সালের সংশোধনী বর্তমান ব্যবস্থার জন্য আর উপযুক্ত নয় যেখানে সংসদ কখনও বিলুপ্ত হয় না। এটা বাদ দিয়ে দেয়াই সঙ্গত। দ্বিতীয আরেকটি বিকল্প হতে পারে যে, নতুন সংসদ সদস্যরা শপথ নেওয়ার মুহূর্ত থেকে রাষ্ট্রপতি আগের সংসদ ভেঙে দিতে পারেন।
কেউ কেউ বলেন, আগের সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার তিন মাস আগে তফসিল ঘোষণার পর সংসদ ভেঙে দেয়ার সুযোগ নেই। তবে আমার মতে, ৫৭(২), ৭২(৩) এবং ১২৩(৩) অনুচ্ছেদে এমন কিছু নেই যা একজন প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতিকে যেকোনো সময় সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দিতে নিষেধ করে। অবশ্য এখানে একটা ঝুঁকি আছে। ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী এবং দলীয় রাষ্ট্রপতি ভোটের মাঠের অবস্থা খারাপ দেখলে ইতোমধ্যে তফসিল হয়ে যাওয়া নির্বাচনের আগ মুহূর্তে সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। এর ফলে ১২৩(৩)(খ) অনুচ্ছেদের সুযোগ নিয়ে তারা নির্বাচন আরো তিন মাস পিছিয়ে দিতে পারেন। এটি অনেকটা কোন প্রধানমন্ত্রী সংসদের আস্থা হারানোর পর পদত্যাগ না করে বরং রাষ্ট্রপতিকে সংসদই ভেঙে দিতে বলার মতো মতো অবস্থা।
সৌভাগ্যবশত, অনুচ্ছেদ ৫৭(২)-তে এ সমস্যার সমাধান আছে। বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি এ পরামর্শটি তাৎক্ষণিক গ্রহণ করবেন না। বরং সংসদ ভেঙে না দিয়ে দেখবেন আর কেউ মেজরিটির সমর্থন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন কিনা। একই যুক্তিতে, আমরা এখানেও বলতে পারি যে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর এই নির্বাচনপূর্ব পরামর্শকেও উপেক্ষা করতে পারেন। এটি রাষ্ট্রপতির বিবেচনা প্রসূত ক্ষমতা (discretionary power)।
তবে আরও ভাল ব্যবস্থা হিসেবে আমরা সংবিধান সংশোধন করে অনুচ্ছেদ ৫৭(২) এর মতো একটা বিধান ১২৩(৩) অনুচ্ছেদেও যোগ করতে পারি। নির্বাচনপূর্ব ঝুঁকি প্রশমনের এ ব্যবস্থা রেখে, একটি নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে এবং একটি নতুন সংখ্যাগরিষ্ঠ দল জানা গেলে আগের সংসদটি ভেঙে দিতে কোন সমস্যা দেখি না। ১১ জানুয়ারি শপথ নেয়ার মুহূর্ত থেকে একাদশ সংসদকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিলুপ্ত ঘোষণা করতে পারতেন। তাহলে এ বিতর্কটি হয়তো আসতো না।
লেখক: প্রভাষক, আইন, ইউনিভার্সিটি অব হল, যুক্তরাজ্য। ইমেইল: j.chowdhury@hull.ac.uk
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম -এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম কর্তৃপক্ষের নয়।